জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেইঞ্জ (Climate change) প্রত্যয়টি এখন বিশ্বজুড়ে সর্বজনীন প্রতিপাদ্য বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি আকারে। আমাদের বসবাসের উপযোগী এই পৃথিবী নামক গ্রহটি দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কী?
কোন এলাকা বা অঞ্চলের ৩০ থেকে ৪০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে বলা হয় জলবায়ু। অন্যভাবে বলা যায়, কোন একটি স্থানের বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড় পড়তা ধরণ বিদ্যমান থাকে তাকে জলবায়ু বলে।
কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে?
আদীকাল থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে জলবায়ুর কিছু পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে আসছে। তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে তার কারণ হিসেবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মানবসৃষ্ট কার্যাবলীকেই দায়ী করছেন।
বিগত কয়েক শতাব্দিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সূর্যের কোন ভূমিকা নেই। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের সর্ব্বোচ নীতি নিধারনকারী সংস্থা ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ (আইপিসিসি) কতৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি মানবসৃষ্ট বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা। বাসস্থানের চাহিদা পূরণে- আবাদি জমি ও বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে। বিধায় খাদ্যের চাহিদা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ক্রমাগত প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, কৃষি উপজাত, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম, জৈব জ্বালানি প্রভৃতি কারণে প্রতিনিয়ত কার্বন নির্গমন হচ্ছে। বাড়ছে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট। গ্রীন হাউজ ইফেক্ট-এর কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, মিথেন, সালফার ডাই অক্সাইড, সিএফসি, নাইটাস অক্সাইড সহ আরও কিছু গ্যাস থাকে যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের ফলেই মূলত কার্বন নিঃসরণ বেড়ে চলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবে আকস্মিক বন্যা, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, ঘুর্ণিঝড়, লবনাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দূর্যোগ বাড়ছে। গ্রীন হাউজ ইফেক্ট -এর কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানিদের ধারণা মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণির বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা আগামীতে ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপ সমুহ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বিজ্ঞানিরা জানিয়েছেন, গ্রীন হাউজ ইফেক্ট -এর কারণে আগামীতে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা সমুদ্র জলে নিমজ্জিত হতে পারে। বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভালুকের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বহু বিচিত্র প্রাণী ও পাখি হারিয়ে গেছে। গোটা মানব সমাজ ও প্রাণীকুল হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন শিশুদের উপর মারাক্তক খারাপ প্রভাব ফেলছে। ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতি তিনজন শিশুর একজন — প্রায় দুই কোটি শিশু প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বহন করে চলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের উপায় কী?
শিল্পায়ন ও বনভূমি ধ্বংসকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানিরা। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণতার অন্যতম কারণ। এজন্য জ্বালানি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। বৃক্ষরাজি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ বিজ্ঞানিদের মতে, প্রতিটি দেশে মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো পরিবেশ বিপর্যস্ত দেশে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। সরকারি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬ ভাগ বনভূমি আছে। কিন্তু পর্যবেক্ষক মহলের হিসাব অনুযায়ী ১০ থেকে ১২ ভাগের বেশি নয়। বেসরকারি হিসেবে আরও কম। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ ও পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপন অতিব জরুরী। পরিবেশ রক্ষার নীতি নির্ধারকদের প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হওয়া আবশ্যক। সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মসূচী প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলে তবেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো নিয়ে আর্ন্তজাতিক ভাবে গণসচেতনতা তৈরী করা জরুরী। টেকসই সচেতনতা সফল করতে মানবিক ও শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা বিশ্বের প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য অত্যাবশ্যক। কেননা অমানবিক ও অশিক্ষিত সমাজ হিতাহিত বোধ উপলব্ধি করার সামর্থ রাখেনা।