গ্রীন হাউজ

বিগত কয়েক শতাব্দি ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবে – জীববৈচিত্র সহ বিভিন্ন প্রাণি ও মানুষের উপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। এর কারণ মূলত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে সৃষ্ট গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া এই অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য দায়ী।

গ্রীন হাউজ

গ্রীন হাউজঃ

শীত প্রধান দেশগুলোতে তৈরী এক ধরনের কাঁচের ঘরকে বলা হয় গ্রীন হাউজ। শীত প্রধান দেশে ফসল উৎপাদন ও কৃষি গবেষণার জন্য এই ঘর নির্মাণ করা হয়। সেখানে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ধরে রেখে উদ্ভিদ ও তরকারি জন্মানো হয়। সূর্যরশ্মি কাঁচ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে কাঁচের ঘরের ভেতর তাপ উৎপন্ন হয়। কিন্তু পরবর্তী কালে তাপ কাঁচের ঘর থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারে না। অতিরিক্ত শীত থেকে ফসল বাঁচাতে এই ঘর নির্মাণ করা হয়।পৃথিবী সূর্য থেকে তাপশক্তি পায়। সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার ফলে যে তাপ সঞ্চিত হয় তার সবটুকু প্রয়োজন হয় না। তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই ভূপৃষ্ঠ তাপের অতিরিক্ত অংশ অবলোহিত রশ্মি বিকিরণের মাধ্যমে নির্গত করে। কিন্তু বায়ুমন্ডলে কিছু গ্যাস রয়েছে । যেমনঃ কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, মিথেন, সিএফসি সহ আরো কিছু গ্যাস যা অবলোহিত রশ্মি শোষণ করে এবং বায়ুমন্ডলের নিম্নস্তরে ও ভূপৃষ্ঠে পুনঃ বিকিরণ করে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমন্ডলের এসব গ্যাস গ্রীন হাউজ কাঁচের আচ্ছাদনের মত কাজ করে। বিধায়, তার অনুসরণে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া নামকরণ করা হয়।

গ্রীন হাউজ গ্যাসঃ

গ্রীন হাউজ গ্যাসে-
কার্বন ডাই অক্সাইড- ৫০%;
মিথেন- ২০%;
সিএফসি- ১০%‘;
নাইট্রাস অক্সাইড- ১০%;
এবং অবশিষ্ট- ১০% অন্যান্য গ্যাস থাকে।

গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার কারণঃ

বৃক্ষ নিধন
বৃক্ষ নিধন

বনাঞ্চলকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। তাই বনাঞ্চল আক্রান্ত হলে পৃথিবী আক্রান্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। বৃক্ষ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে।
পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা। এইসব চাহিদা পূরণে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে। বাড়ছে যানবাহন ও শিল্প-কারখানার প্রয়োজনীয়তা। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রকৃতিতে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে যানবাহন ও শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুমন্ডলে মেশার ফলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমান ক্রমাগত বাড়ছে। ধান ক্ষেত, ময়লা আবর্জনার স্তুপ, কয়লার মজুদ ইত্যাদি উৎস হতে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের স্প্রে ক্যান, ফ্রিজ এবং এয়ারকন্ডিশনার হতে সিএফসি গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বলনের ফলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমান বাড়ছে। এসব গ্যাসের সমন্নয়ে সৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাস ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যার ফলে প্রকৃতি মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ক্ষতিকর প্রভাবঃ

গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তন। যার কারণে ঝড়, ঘুর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছাস, নিম্নচাপ, খরা, তাপদাহ, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, বন্যা, নদী ভাঙন, লবনাক্ততা, ঘন কুয়াশা, শৈত্য প্রবাহ সহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি, বৃক্ষকূল, মানুষ, জীববৈচিত্র ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণির বরফ গলতে শুরু হয়েছে। যার কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চল তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম । যার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ এলাকা সমুদ্র জলে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নদী-নালা, খাল-বিল প্রভৃতি জলাশয় শুকিয়ে যাবে। ফলে ফসল উৎপাদনে কৃষক বাঁধার সম্মুখীন হবে। এতে খাদ্যাভাব দেখা দেবে।

গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে করণীয়ঃ

  • কার্বন শোষণে বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও বৃক্ষ রোপন করতে হবে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, পতিত জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, রাস্তার ধারে প্রভৃতি জায়গায় বৃক্ষ রোপনে উদ্যোগী হতে হবে।
  • বৃক্ষ কর্তনের প্রয়োজন কমাতে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র তৈরিতে বিকল্প কাঁচামাল ব্যাবহার করতে হবে।
  • শিল্প-কারখানা কার্বন নির্গমনের অন্যতম প্রধান উৎস। তাই শিল্প-কারখানা হতে কার্বন নির্গমন বন্ধে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • যতটা পারা যায় ব্যক্তিগত ইঞ্জিন চালিত যানবাহন কম ব্যবহার এবং বাইসাইকেল চালনায় উৎসাহিত করতে হবে।
  • সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

তথ্যসূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস। লেখক: পংকজ সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *